চাকরি বা সন্তোষজনক চাকরি পাওয়া নিয়ে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। কেউ চাকরি না পেলেই আমরা ভেবে নিচ্ছি, তাঁর যোগ্যতা নেই। ভাবখানা এমন, পৃথিবীতে যোগ্যতাই যেন চাকরি পাওয়ার একমাত্র উপায় বা মাধ্যম। আবার যাঁরা চাকরিতে সন্তোষজনক মাইনে পাচ্ছেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেও বলা হচ্ছে, যোগ্যতা বা দক্ষতার ঘাটতির কারণেই তাঁরা বেতন কম পাচ্ছেন।
কিন্তু ব্যাপারটা কি সব সময় তা-ই? দেশে বেসরকারি খাত কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না, তাই কর্মসংস্থানও সে অনুযায়ী বাড়ছে না। বিবিএসের জরিপ থেকে জানা যায়, দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বিপুল। বেসরকারি খাতের চাকরি বাড়ছে না বলে তরুণেরা হন্যে হয়ে সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছেন।
৩৮ তম বিসিএসে ৩৭ তম বিসিএসের তুলনায় ৪২ ভাগ আবেদন বেশি পড়েছে। এর পেছনে সরকারি চাকরির বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং সামাজিক প্রতিপত্তি ও মর্যাদার বিষয় থাকলেও আরেকটি কারণ আছে যার দিকে আমরা নজর দিচ্ছি না। সেটা হলো বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত হারে না বাড়া। সরকারি চাকরি সীমিত, সবাই তা পাবেন না। তাহলে যাঁরা সরকারি বা বেসরকারি কোনো চাকরি পাচ্ছেন না, তাঁরা কি শুধু যোগ্যতার অভাবেই পাচ্ছেন না? নাকি চাকরির অভাবে তাঁরা বেকার হয়ে পড়ছেন?
প্রশ্ন হলো, এই চাকরি পাওয়া কি শুধু ব্যক্তিক ব্যাপার, এর সঙ্গে কি রাষ্ট্রের সম্পর্ক নেই? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তো নাগরিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু এই সত্যটি আমরা একরকম ভুলতে বসেছি। আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে ধরে নিচ্ছি, এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা নেই। তবে এ কথা বলছি না যে রাষ্ট্র সবাইকে সরকারি চাকরি দেবে।
সক্ষম মানুষেরা যেন কাজ পান, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বেকার ভাতার কথা এই সময়ে আর বললাম না। পশ্চিমা দেশগুলোতে একসময় রাষ্ট্রের ভূমিকা অনেক দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকে অর্থনীতিতে নব্য উদারনীতিবাদী ধারা গড়ে ওঠার পর থেকে রাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমশ সংকুচিত হতে শুরু করে।
শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান-এসব মৌলিক খাতও তখন বেসরকারি খাতে চলে যেতে শুরু করে। রাষ্ট্র তখন থেকে ধীরে ধীরে বাজারের রক্ষকে পরিণত হতে শুরু করে। নব্য উদারনীতিবাদী চিন্তায় প্রতিযোগিতা হচ্ছে মানবীয় সম্পর্কের মূল বৈশিষ্ট্য। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে মানুষের দক্ষতা বাড়ে, কিন্তু সেটাই একমাত্র নিয়ামক হতে পারে না। এই ব্যবস্থায় নাগরিকেরা স্রেফ ভোক্তায় পরিণত হন। আর নাগরিকেরা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেন বড়জোর ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্য দিয়ে। এ প্রক্রিয়ায় মেধাবীদের মূল্যায়ন হয় আর অদক্ষদের শাস্তি হয়।
এ ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা এত উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত যে তা কমানোর চেষ্টা স্বাধীনতার প্রতিকূল বলে গণ্য হয়। এ ব্যবস্থায় কর ও নিয়মকানুন শিথিল করা হয়। সরকারি সেবা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। শ্রমিক সংগঠন ও যৌথ দর-কষাকষি সংস্থাগুলোকে বাজার অর্থনীতির বিকৃত রূপ হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হলো, এখানে অসমতাকে পবিত্র জ্ঞান করা হয়। এটা নাকি উপযোগিতার পুরস্কার, যার মাধ্যমে সম্পদ সৃষ্টি হয়। সে কারণে সমতাভিত্তিক সমাজ তৈরির সংগ্রাম অনুৎপাদনশীল ও নৈতিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু। বাজারই নাকি ঠিক করে দেয়, কার কী প্রাপ্য। বলা বাহুল্য, আমাদের সমাজেরও বিপুলসংখ্যক মানুষ এই যুক্তিতে বিশ্বাস করেন। তাঁরা মনে করেন, এটাই নিয়তি।
এই যে প্রতিযোগিতার তত্ত্ব, তা কিন্তু মূল জায়গা থেকে আমাদের চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এই যুক্তির আলোকে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, যাঁরা বিপুল পরিমাণে ধন সঞ্চয় করেছেন, তাঁরা নিজের যোগ্যতায় তা করেছেন। অথচ এখানে রাজনৈতিক, শ্রেণি ও শিক্ষাগত সুবিধার যে ভূমিকা আছে, তা ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এই যুক্তি হালে অনেকটা পানি পেয়েছে। ফলে গরিব ও বেকারদের অনেকেই মনে করেন যে তাঁদের উদ্যোগ ও উদ্যমের ঘাটতির কারণেই তাঁদের এই পরিণতি। অর্থাৎ প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে যাঁরা পিছিয়ে পড়ছেন, তাঁরা ‘পরাজিত’ হওয়ার তকমা পাচ্ছেন। এই ‘পরাজিত’ মানুষদের জীবনে কী দুর্যোগ নেমে আসে, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। তবে পৃথিবী পরিবর্তনশীল, বলা যায়, পরিবর্তনই তার একমাত্র নিয়তি।
প্রযুক্তির যে বিকাশ ঘটছে, তাতে বাজারের নিয়মে অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি বাড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তার বিপরীতে প্রযুক্তিবিদ বা টেকনিক্যাল মানুষের বেতন আকাশচুম্বী হতে শুরু করেছে। কিন্তু জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম মজুরি কত হওয়া উচিত, তা ঠিক করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এখানেই তাকে সুনির্দিষ্ট কাজ করতে হবে। মালিকেরা যাতে জোট গঠন করে শ্রমিকদের মজুরি কমিয়ে রাখতে না পারেন, রাষ্ট্রকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
গার্মেন্টস খাতে আমরা যেটা দেখি। আবার নিয়োগদাতাদের অভিযোগ, তাঁরা দক্ষ কর্মী পাচ্ছেন না। এই অভিযোগ আমলে নিতে গেলে আমাদের দেখতে হবে, শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি আছে কি না। বিশ্বায়নের যুগে দক্ষতা ও যোগ্যতা ছাড়া বাজারে টিকে থাকা যাবে না, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই সরকারকে শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী করতে হবে।
আমাদের মতো দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সুশাসনের অভাব। এটা না থাকায় দেশে কাঙ্ক্ষিত হারে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগ আসার অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সুশাসনের অভাবের জন্য তা আসছে না। সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে সরকার।
সরকার যদি বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, তাহলে বেকারত্ব সমস্যা এমনিতেই অনেকটা ঘুচে যাবে। এটাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। অন্যদিকে আমাদের মধ্যবিত্তের মানসিকতায়ও পরিবর্তন আনা জরুরি। শুধু চাকরি করাটাই জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। আমাদের উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা অর্জন করা জরুরি। কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়াটা অনেক কঠিন কাজ।
দেশে এখন ব্যাংকঋণ থেকে শুরু করে অবকাঠামো ও উপকরণজনিত সুবিধা পাওয়া হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ব্যাপার। অথচ খেলাপি ঋণের পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। যাঁরা ঋণ ফেরত দেবেন না, তাঁদেরই ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রকৃত উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। এটা আর্থিক খাতের সুশাসনজনিত সমস্যা, যার সমাধান করতে পারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার।
বড় শিল্পে সব মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে না। গ্রামগঞ্জে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। জার্মানির মতো উন্নত দেশেও এখন মাঝারি উদ্যোগের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। অথচ আমরা এর গুরুত্ব ঠিকঠাক বুঝতে পারছি না।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উপাত্ত মতে, বাংলাদেশের শ্রমশক্তি বছরে গড়ে ২ শতাংশ হারে বাড়ছে। এক হাজার শূন্যপদের বিপরীতে এক লাখ মানুষের আবেদন পড়লে তা কাজের কথা নয়। সরকারের ভূমিকা ছাড়া এই বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার যথাযথ রাষ্ট্রীয় নীতি, যা সব সরকারকে মেনে চলতে হবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র শুধু বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখবে না, তাকে সবারটাই দেখতে হবে। প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক ও অনুবাদক।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।